জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদ পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ২১টি জুলাই শহিদ পরিবার ও সাতজন আহতের মধ্যে আর্থিক চেক হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এ সময় প্রধান উপদেষ্টা জুলাই শহিদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেন, দেশে যেন কোনো সহিংসতা ও হানাহানি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সবসময় ভাবি যাদের কারণে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশটাকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলার সাহস করছি তাঁদের এই ত্যাগ কোনো নিক্তি দিয়ে মাপা যাবে না।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের ইতিহাসের স্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘আপনারা জীবন্ত ইতিহাস। মনের গভীর থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যে জাতি ইতিহাসকে স্মরণ করতে পারে না সে জাতি, জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে না। এই স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে জাতির পক্ষ থেকে আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’

শহিদ পরিবার ও আহতদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজকে থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অংশ হলেন। এটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এর বাইরেও আপনাদের দায়িত্ব সমাজের সবাইকে গ্রহণ করতে হবে।

সকল হত্যাকাণ্ড ও গুম-খুনের বিচার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিচার তাৎক্ষণিকভাবে করতে গেলে অবিচার হয়ে যায়। বিচারের মূল জিনিসটা হলো সুবিচার হতে হবে, অবিচার যেন না হয়। আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই এই সংগ্রাম হয়েছে, এই আত্মত্যাগ হয়েছে। আমরা যদি অবিচারে নামি তাহলে তাদের আর আমাদের মধ্যে তফাৎটা থাকল কোথায়? আমরা অবিচারে নামবো না। আমরা যারা অপরাধী তাদের পুলিশের হাতে, আইনের হাতে সোপর্দ করবো। যারা অপরাধী নয়, পুলিশের হাতে দেওয়ার মতো নয় তাদের মানুষ করবো।

তিনি আরও বলেন, ভাই, এদেশ আমরা একসাথে গড়ি, যেদেশ আমরা একসাথে গড়ার স্বপ্ন দেখছি, তোমরাও সে স্বপ্ন দেখ। এদেশ আমার একার না, তোমারও এদেশ। তুমি এদেশের সন্তান। আমিও এদেশের সন্তান। তুমি আমাকে বহু কষ্ট দিয়েছো। আমি তোমারে কষ্ট দেব না। আমরা এক যোগে যত তাড়াতাড়ি পারি এটাকে একটা সুন্দর দেশ বানাবো, যারা অপরাধী তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। যারা অপরাধী নয় তাদের সৎ পথে নিয়ে আসতে হবে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান। বৈঠকে তিনটি শহিদ পরিবারের সদস্য এবং তিনজন যোদ্ধা বক্তব্য রাখেন। তাঁরা হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রাপ্তি, আর্থিক সহযোগিতা ও পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এ সময় তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

বৈঠকে আহত ও শহিদ পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জুলাই শহিদ ও জুলাই যোদ্ধাদের জন্য সরকারের গৃহীত কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানের শহিদরা ‘জুলাই শহিদ’ এবং আহতরা ‘জুলাই যোদ্ধা’ নামে অভিহিত হবেন এবং পরিচয়পত্র পাবেন। প্রতিটি শহিদ পরিবার এককালীন ৩০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পাবে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা এবং আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাইয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি প্রতিটি শহিদ পরিবারকে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করা হবে। শহিদ পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন।

জুলাই যোদ্ধারা দুটি মেডিকেল ক্যাটাগরি অনুযায়ী সুবিধাদি পাবেন। গুরুতর আহতদের ‘ক্যাটাগরি এ’ অনুযায়ী, এককালীন ৫ লাখ টাকা প্রদান করা হবে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ২ লাখ টাকা প্রদান করা হবে এবং ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ৩ লাখ টাকা প্রদান করা হবে। এর পাশাপাশি, গুরুতর আহত প্রত্যেক জুলাই যোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসা সুবিধা প্রাপ্ত হবেন ও মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে দেশি-বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাবেন। তারা কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন সুবিধা পাবেন।

‘ক্যাটাগরি বি’ অনুযায়ী, জুলাই যোদ্ধাদের এককালীন ৩ লাখ টাকা প্রদান করা হবে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ১ লাখ টাকা প্রদান করা হবে। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে নগদ (ব্যাংক চেকের মাধ্যমে) ২ লাখ টাকা প্রদান করা হবে। এর পাশাপাশি, মাসিক ১৫ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হবে। এছাড়া তারা কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি/আধাসরকারি কর্মসংস্থান প্রাপ্য হবেন।

জুলাই যোদ্ধাদের পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে। তাঁরা পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধাদি পাবেন। এখন পর্যন্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৩৪ জন শহিদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এছাড়া আহতদের তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।