১১৫৬ শিক্ষকের ভুয়া সনদ, চাকরি করছেন বহার তবিয়তে
প্রতিকী ছবি
জয়পুরহাটের কালাই ময়েন উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১২ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান মো. সাইফুল ইসলাম। তাঁর এমপিওভুক্তির ইনডেক্স নম্বর ৫৪৭৩৯০। বিদ্যালয়টি ২০২২ সালে জাতীয়করণ হয়। তাঁর চাকরিও সরকারি হয়ে যায়।
এখন তিনি বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ তাঁর ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) সনদটি জাল বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ২০০৮ সালে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমণ্ডি ক্যাম্পাস থেকে সিজিপিএ ৩.১৯ পেয়ে বিএড ডিগ্রি অর্জনের সনদ জমা দিয়েছিলেন।
কিন্তু বিদ্যালয়টির তখনকার ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এই বিএড সনদটি সঠিক কি না, তা যাচাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর চিঠি দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্য চিঠিতে জানায়, ‘রেকর্ডপত্র পরীক্ষা ও যাচাই করে সাইফুল ইসলামের বিএড সনদের সঠিকতা পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর উল্লিখিত প্রগ্রামের সনদপত্র এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়নি।’
মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ধানমণ্ডিতে দারুল ইহসানের চারটি ক্যাম্পাস ছিল। আমি পাস করেছি ধানমণ্ডি-১২০৫ ক্যাম্পাস থেকে। আর স্কুল কর্তৃপক্ষ সনদ যাচাই করেছে ধানমণ্ডি-১২০৯ ক্যাম্পাস থেকে। ফলে তারা সঠিক তথ্য পায়নি। অভিযোগ ওঠার পর শিক্ষার বিভিন্ন দপ্তর থেকেও আমার বিএড সনদ একাধিকবার যাচাই করেছে। সবাই সঠিক পেয়েছে।’
সম্প্রতি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জাল সনদসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সেখানে এমন এক হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের জাল সনদের তথ্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭৯৩ জন শিক্ষকের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ, ২৯৬ জনের কম্পিউটার শিক্ষার সনদ এবং ৬৭ জনের বিএড, গ্রন্থাগার, সাচিবিকবিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের সনদ জাল।
সাইফুল ইসলামের সনদ যাচাইকালে একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সনদ যাচাইয়ের আবেদনটি সাইফুল ইসলামের উল্লিখিত ক্যাম্পাস ধানমণ্ডি-১২০৫-এ পাঠানো হয়েছে, যা আবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তারা যাচাই শেষে যে চিঠি পাঠিয়েছে, সেখানে ধানমণ্ডি-১২০৯ লেখা আছে। আমাদের জানা মতে, দারুল ইহসানের ধানমণ্ডির মূল ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য ক্যাম্পাস থেকে পৃথকভাবে সনদ যাচাই বৈধ নয়। আর তিনি একেকবার একেক ক্যাম্পাসের সনদ জমা দিচ্ছেন। এতে বোঝা যায়, তাঁর সনদে ঝামেলা রয়েছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার। এর মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০ হাজার ৩১৬টি, কলেজ দুই হাজার ৬৬৪টি, মাদরাসা ৯ হাজার ২৯২টি এবং দুই হাজারের মতো কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক ‘শিক্ষক নিবন্ধন সনদ’ বাধ্যতামূলক করা হয়। বতর্মানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন প্রায় চার লাখ শিক্ষক ও এক লাখ কর্মচারী, যাঁরা সরকারি বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন।
এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. সাইফুল্লাহিল আজম বলেন, ‘আমাদের এখানে আগে একজন সিস্টেম অ্যানালিস্ট ছিলেন, যিনি জাল সনদ কারবারে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি কয়েক বছর আগে চাকরি ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। আর একজন ড্রাইভারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ব্যাপারে দুদক তদন্ত করছে। আমরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বলেছি, নিয়োগের সময় তারা যেন শিক্ষকদের সনদ যাচাই করে নেয়। আগে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন তাঁদের সনদ সঠিক আছে কি না, তা যাচাই করতে হলে মন্ত্রণালয় বা মাউশিকে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। তবে শিক্ষার কোনো দপ্তর যদি কোনো শিক্ষকের সনদ যাচাই করতে চায়, তাহলে তা আমরা করে দেব। এ জন্য কোনো ফি দিতে হবে না।’
ডিআইএর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৮ মে জাল সনদধারী ৬৭৮ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের চিঠি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরে পাঠায়। সেই চিঠিতে শিক্ষকদের এমপিও বন্ধ করা ও বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া জাল সনদধারী শিক্ষকদের অবৈধভাবে গ্রহণ করা বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে ফেরত প্রদানেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চিহ্নিত শিক্ষকদের অবসর সুবিধা বাতিলের পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক ফৌজদারি মামলা করতে বলা হয়েছে।
মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরে আমরা জাল সনদধারী শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করেছি। তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে বলেছি। এ ছাড়া পরিদর্শনের সময় শিক্ষকদের সনদ সন্দেহজনক হলে তা যাচাইয়ের জন্য আমরা ডিআইএকে বলেছি। এতে অনেক জাল সনদ ধরা পড়ছে।’
নাম প্রকাশ না করে ডিআইএর একজন পরিদর্শক বলেছেন, ‘আমাদের যে জনবল, তাতে বছরে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা যায় না। তাতেই যদি এত শিক্ষকের সনদ জাল পাওয়া যায়, তাহলে সব শিক্ষকের সনদ যাচাই করলে জাল সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৩০ হাজারের কম হবে না।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে পরিচালনা কমিটির একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাদের হাতেই ছিল নিয়োগ কার্যক্রম। তারা বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যে কাউকে নিয়োগ দিতে দ্বিধাবোধ করত না। আর এসব নিয়োগে অনেক শিক্ষকই জাল সনদ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন। আর এমপিওভুক্তি প্রক্রিয়ায়ও নানা ধরনের অনিয়ম রয়েছে।